বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ রোল মডেল: প্রধানমন্ত্রী
মুক্তআলো২৪.কম
মুক্ত আলো
প্রকাশিত : ০৬:৫৮ পিএম, ২৯ মে ২০২৪ বুধবার
বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ রোল মডেল: প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।শেখ হাসিনা সংলাপের মাধ্যমে সকল দ্বন্ধ-সংঘাত নিরসন, চলমান যুদ্ধ বন্ধ এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতার অর্থ মানবজাতির কল্যাণে ব্যয় করার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার পাশাপাশি বৈশি^ক শান্তি প্রতিষ্টার প্রচেষ্টায় একটি দায়িত্বশীল ও নির্ভরযোগ্য নাম। আমরা সর্বজন স্বীকৃত এবং বিশ্বের বুকে একটি রোল মডেল।’
প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস-২০২৪’ উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
তিনি বলেন, জাতির পিতার পররাষ্ট নীতি ’সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’, বিশ^শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতার অঙ্গীকার ও আমাদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুসরণ করে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ‘ব্লু হেলমেট’ পরিবারের সদস্য হয়।
সরকার প্রধান বলেন, বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ১৩টি স্থানে ৪৯৩ জন নারীসহ ৬০৯২ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা যেখানে কাজ করছে সেসব রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা তাদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
তিনি বলেন, ‘প্রশংসা শুনে গর্বে আমার বুকটা ভরে যায়।’
শেখ হাসিনা বলেন, শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আজ একটি দায়িত্বশীল ও নির্ভরযোগ্য নাম। আমরা সর্বজন স্বীকৃত এবং বিশে^র বুকে রোল মডেল। এই অর্জনের পেছনে রয়েছে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর টেকসই. পরিশ্রমী নিবেদিত প্রাণ সদস্যদের মহান আত্মত্যাগ ও অমূল্য অবদান।
তিনি ১৬৮ বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের অবদানের কথা স্মরণ করেন যারা বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আত্মত্যাগ করেছেন এবং ২৬৬ জন গুরুতর আহত হয়েছেন।
শান্তিরক্ষায় অবদান রাখতে গিয়ে আত্মোৎসর্গকারীদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে তাঁদের পরিবারের সদস্যদেরও সমবেদনা জানান তিনি। স্বজন হারাবার বেদনা যে কি, তিনি তা জানেন বলেও এ সময় উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা জাতিসংঘ শাস্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের ৩৬ বছর উদযাপন করছি। বাংলাদেশ আজ বিশে^র বৃহৎ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারি দেশ এবং সকলে অত্যন্ত সুনাম ও গৌরবের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। তিনি এ সময় বিশে^র নানা প্রান্তে কর্মরত সকল বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের শুভেচ্ছা জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতার আদর্শ অনুসরণ করে আমরা বিশ^ শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছি। শান্তিরক্ষা মিশন ছাড়াও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরাম গুলোতেও আমরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও অবদান রাখছি।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের জাতিসংঘে ‘কালচার অব পিস’ (শাস্তির সংস্কৃতি) প্রস্তাব উত্থাপন করে যা ১৯৯৯ সালে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, সেই থেকে প্রতিবছর জাতিসংঘে বাংলাদেশের ‘ফ্লাগশিপ রেজ্যুলেশন’ এই ‘কালচার অব পিস’ সর্বস্মতিক্রমে গৃহীত হয়ে আসছে। পরবর্তীতে জাতিসংঘ ২০০০ সালকে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার অব কালচার অব পিস’ হিসেবে ঘোষণা করে। যার মাধ্যমে শান্তির সংস্কৃতি প্রস্তাবের ২৫ তম বর্ষ উদযাপিত হতে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘এজেন্ডা ২০৩০ বাস্তবায়নে কালচার অব পিস প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য বলে আমার বিশ্বাস।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ, সিনিয়র পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গুয়েন লুইস।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আহত তিন জনের হাতে সম্মাননা তুলে দেন।
তিনি ইউএন পিস কিপার্স জার্নাল এর (১০ম ভলিউম) মোড়কও উন্মোচন করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আত্মত্যাগকারী বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের কৃতিত্বের ওপর একটি ভিডিও প্রামাণ্যচিত্র ও প্রদর্শন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী পরে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে কর্মরত বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদেও সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
জাতির পিতা নিজেকে বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত ও নির্যাতিত মানুষের দূত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, ‘জাতির পিতা বলতেন-বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত শোষক ও শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে।’ তাই সব সময় তিনি শোষিত মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা রোধ, সাম্য-মৈত্রী, গণতন্ত্র রক্ষা এবং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ ‘বিশ্ব শান্তি পরিষদ’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৩ সালের ২৩ মে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে। জাতির পিতা সেই পদক উৎসর্গ করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী বীর শহীদ এবং সেনানীদের।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দ্বন্দ্ব সংঘাত, যুদ্ধ আজ বিশ্ব শান্তি বিঘ্নিত করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজার ইসরায়েলি হামলায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু। সেখানে গণহত্যা চলছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা ইত্যাদি মানবজাতির জন্য এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি ঠিক জানি না এই সংঘাত বা যুদ্ধ মানব জাতির জন্য কী কল্যাণ বয়ে আনছে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা প্রতিনিয়ত যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, ততই মানুষের জীবন আরো বেশি দুর্বিসহ হয়ে উঠছে। বিশেষকরে নারী-শিশুরা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে। যুবকরা অকাতরে জীবন দিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যুদ্ধ চাইনা, শান্তি চাই। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সব কিছু সমাধান করতে চাই।
তিনি বলেন, বিশে^ এখনও বিপুল সংখ্যক মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে রয়েছে। কোটি কোটি মানুষ দু’বেলা খাবার পায় না। রোগের চিকিৎসা পায় না। শিশুরা শিক্ষা পায় না। তারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। যারা অস্ত্র তৈরি এবং অস্ত্র পতিযোগিতায় এত অর্থ ব্যয় করছে তাদের কাছে আমার আহ্বান-আমরা শান্তির কথা বলি কিন্তু সংঘাতে লিপ্ত হই কেন?
সরকার প্রধান বলেন ‘এই যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে এই অর্থ যদি ক্ষুধার্ত মানুষের আহারের ব্যবস্থা, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থায় ব্যয় হতো তাহলে এই পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতো। মানুষের জীবনমান উন্নত হতো। মানুষ সুন্দরভাবে বাঁচতে পারতো। কিন্তু এই সংঘাত প্রতিনিয়ত মানুষকে আরো কষ্টের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কাজেই আমি সবসময় যেখানেই যাই এই একটি আহবানই জানাই সংঘাত নয়, যদি কোন সমস্যা থাকে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার। সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কাজ।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেই সাথে এই অস্ত্র তৈরি আর প্রতিযোগিতার অর্থ যে সমস্ত দেশ এখনো জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছে সেই জলবায়ুর অভিঘাত থেকে মানবজাতিকে রক্ষার জন্য সেই তহবিলে সেই অর্থ দিতে পারেন। তাছাড়া ক্ষুধার্ত ও শিক্ষাবঞ্চিত যে সমস্ত শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়নে ব্যবহার করতে পারেন। সেই আহবান আজকে আমি সকলকে জানিয়ে যাচ্ছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, নারীর অধিকার এবং লিঙ্গ সমতা নিশ্চিতে তাঁর সরকারের পদক্ষেপ ‘উইমেন পিস এন্ড সিকিউরিটি এজেন্ডা’ তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বর্তমানে অন্যতম বৃহৎ নারী শান্তিরক্ষী প্রেরণকারি দেশ হিসেবেও পরিচিতি লাভ করছে। এই পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বমাট ৩ হাজার ৩৮ জন নারী শান্তিরক্ষী সফলতার সঙ্গে মিশন সম্পন্ন করেছেন। এজন্য আরো অধিক পরিমানে নারী শান্তি রক্ষী প্রেরণেরও দাবি উঠেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস’ এর আহবানে একাত্মতা ঘোষণা করে দারিদ্রের অবসান, পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষা এবং জনগণের শান্তি ও সম্প্রীতি নিশ্চিতকল্পে বাংলাদেশে নিয়োজিত জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রমে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
তিনি এই মহতী উদ্যোগে বাংলাদেশের পাশে থাকার জন্য বাংলাদেশে নিয়োজিত জাতিসংঘের বিভন্ন সংস্থাকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও জানান।
দেশব্যাপী কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা এবং সেখান থেকে জনগণকে ৩০ প্রকারের ওষুধ বিনামুল্যে প্রদানে সরকারের পদক্ষেপের উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকের অনুকরণে সম্প্রতি সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োজিত বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সহায়তায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সে দেশের প্রেসিডেন্টের নামে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক চালুর জন্যও সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিদেশের মাটিতে জাতির পিতার প্রতি এই সম্মাননা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি গৌরবের অধ্যায়।’
শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্ব শান্তি নিশ্চিত করা এখন অতীতের চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তির সাম্প্রতিক প্রসার ও অগ্রযাত্রার সাথে সাথে বাড়ছে নতুন নতুন হুমকি। ফলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনগুলোতে শান্তিরক্ষীদের বহুমাত্রিক জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তাই শান্তিরক্ষা মিশনগুলো উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে সমৃদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা এখন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিশন এলাকার পরিবেশ, আবহাওয়া এবং ভূমির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নত প্রযুক্তির সামরিক সরঞ্জামাদি ও পোষাকসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশ কন্টিনজেন্ট সমূহে অত্যাধুনিক ‘মাইন রেসিষ্ট্যান্ট অ্যামবুশ প্রটেকটেড’ যানবাহন এবং শান্তিরক্ষীদের যোগাযোগের জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন এবং প্রশিক্ষণ একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীগণ যাতে বিশে^র সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং এবং বিপজ্জনক অঞ্চলসমূহে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে সেজন্য তাদের সময়োপযোগী প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এ সময় তিনি শান্তিরক্ষীদের প্রশিক্ষণে ’৯৬ সালে প্রথমবার সরকারে এসেই ‘বিপসট’ (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং) প্রতিষ্ঠার উল্লেখ করেন। যা এখন আন্তর্জাতিক মর্যাদা পেয়েছে।
মুক্তআলো২৪.কম