মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র:অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
মুক্ত আলো
প্রকাশিত : ০৭:২১ পিএম, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ শুক্রবার
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল):
আগাম টাকা দিয়ে যেখানে ভ্যাকসিন না পাওয়ার হতাশা দেশে দেশে, সেখানে আমরা ভারত থেকে ভ্যাকসিনটি পাচ্ছি ভারত সরকারের সমান দামে। আমাদের চেয়ে ঢের বেশি দামে এই একই ভ্যাকসিন কিনছে সৌদি আরব আর থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো।
২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে নয়াদিল্লিতে যখন পৌঁছালাম, সন্ধ্যা তখন পেরিয়ে গেছে। কোভিড প্যান্ডামিক শুরুর পর এটাই আমার প্রথম বিদেশযাত্রা। কোভিডে বদলে গেছে অনেক কিছুই। বদলে গেছে বিমানযাত্রাও। তাই বলে যে এতটা ধারণা ছিল না। নানা ঝামেলা শেষে হোটেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেশ রাত হয়ে গেল। হোটেলে পৌঁছেই আবার অর্গানাইজারদের সঙ্গে মিটিং। দিল্লিতে এবারে আসার উদ্দেশ্য গণহত্যার ওপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেয়া। আলোচনায় বসেই টের পেলাম সকালে বিপ্লব ঘটে গেছে। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশের তিন বাহিনীর শতাধিক সদস্যের একটি কন্টিনজেন্ট। এমনটা এবারই প্রথম। ‘জয় বাংলা, জয় হিন্দ’ স্লোগানে মুখর লাখো উপস্থিতির বিপুল হর্ষধ্বনির মাঝেই ব্যান্ডে এ সময় দিল্লির আকাশে-বাতাসে উঠেছে রনি, ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে...’। রাতের আলোচনাতেও আগামীকালের সম্মেলনের খুঁটিনাটি ছাপিয়ে তারই অনুরণন।
দুই.
কদিন আগের ঘটনা। বাংলাদেশে নবনিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে একাত্তরের একটি নতুন ভাস্কর্যের উদ্বোধন করেছেন, নাম ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র’। একাত্তরের ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের পর বিজয়ী মিত্রবাহিনীর বাংলাদেশীয় ও ভারতীয় সদস্যদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালিয়েছিল পাকিস্তানিরা। শহীদ হন মিত্রবাহিনীর শতাধিক সদস্য। বাঙালি আর ভারতীয় রক্তের মিলিত স্রোতোধারায় যে বাংলাদেশের জন্ম, তারই প্রতীক এই ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র’।
তিন.
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপিরবারে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণের পর তার রক্তের উত্তরাধিকার জীবিত দুই কন্যা আমাদের প্রিয় দুই আপার ঠাঁই হয়েছিল নয়াদিল্লিতে। সেদিন আপারা নয়াদিল্লিতে নিরাপত্তা না পেলে কোন ভাগাড়ে থাকত আজকের বাংলাদেশ, তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতেই পারে। তবে আজকের বাংলাদেশ যে আফগানিস্তান বা সিরিয়ার চেয়ে ভালো কিছু হতো না, সেটুকু চোখ বন্ধ করে বলে দেয়ার মতো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত আমাদের চারপাশে দৃশ্যমান।
চার.
কোভিড প্যান্ডামিকের পর্যুদস্ত বিশ্বে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলো। আমাদের দুই প্রতিবেশী চীন এবং ভারতও এগিয়ে এসেছে। চীনা প্রস্তাব ছিল সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের। অনেকের মতো আমিও আপ্লুত হয়েছিলাম চীনা ভালোবাসায়। এ নিয়ে আবেগপ্রবণ এখনো অনেকে। আমি নই। ব্রাজিলে সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে সাফল্য ৫০ শতাংশের কোঠায়। অনেকটা বাতিলের খাতায় এখন এই ভ্যাকসিনটি। অন্যদিকে ভারত থেকে ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কেনায় আমরা শতকোটি টাকা খরচ করছি বলে মনটা খুঁতখুঁতে অনেকেরই। অথচ শোনা যায় শুধু ভ্যাকসিনের ট্রায়াল দিতেই নাকি সিনোভ্যাকের আবদার ছিল প্রায় তেমনটাই।
পাঁচ.
আগাম টাকা দিয়ে ফাইজারের ভ্যাকসিন না পাওয়ার ক্ষোভে মাথা কুটছে ইউরোপ, কানাডা আর আমেরিকা। পরিস্থিতি এতটাই বেকায়দা যে হাঙ্গেরির মতো দেশ পাঁচ হাজার ডোজ ভ্যাকসিনের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তো কার্যত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে অনুমোদন ছাড়া ইউনিয়নের বাইরে ভ্যাকসিন রপ্তানির ওপর। অন্যদিকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা তো স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছে টাকা নিয়েছে বলেই তারা নির্ধারিত সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ভ্যাকসিন সরবরাহে বাধ্য নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যাও এসব নিয়ে দফায় দফায় ক্ষোভ ঝাড়ছে। কিসের কী? কিছুই তাতে এসে যায় না কারোরই। যার যার বুঝ তার তার কাছে।
ছয়.
ভারতের যে কোভিশিল্ড নেয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, সেটি ভারত সরকারের উপহার। আমার মতো এ দেশের আরো ১০ লাখ নাগরিক এই উপহারের ভ্যাকসিন নেয়ার সুযোগ পাবেন। ভারত শুধু যে তার নিজের চাহিদা পূরণ না করেই বাংলাদেশে ভ্যাকসিন রপ্তানি করছে তা-ই নয়, ভারতীয় উপহারের সবচেয়ে বড় চালানটিও মুম্বাই থেকে ঢাকাতেই এসেছে। আর আগাম টাকা দিয়ে যেখানে ভ্যাকসিন না পাওয়ার হতাশা দেশে দেশে, সেখানে আমরা ভারত থেকে ভ্যাকসিনটি পাচ্ছি ভারত সরকারের সমান দামে। আমাদের চেয়ে ঢের বেশি দামে এই একই ভ্যাকসিন কিনছে সৌদি আরব আর থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো।
সাত.
দুর্মুখের মুখ বন্ধ করা কখনোই সম্ভব না, প্রয়োজনও নেই। পাগল তার প্রলাপ বকতেই থাকবে আর জাতীয় সংসদের সমাপনী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী যেমনটি বলেছেন, বাংলাদেশ তার অভীষ্ট গন্তব্যে ছুটে চলবে। আজকের গ্লোবাল ভিলেজের বাস্তবতায় এই গর্বিত ছুটে চলায় ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্রদের’ পথে বাধা হয় সেই শক্তি কোথায়?
লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
-চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
-সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
মুক্তআলো২৪.কম