ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা:অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব

অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব(স্বপ্নীল)

মুক্ত আলো

প্রকাশিত : ০৭:৪৪ পিএম, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ বুধবার

অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব(স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব(স্বপ্নীল)


অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব(স্বপ্নীল):
করোনাকাল, ভ্যাকসিন, ভ্যাকসিন নেয়া-না নেয়ার দোলাচাল- এসব কিছু ছাপিয়ে ইদানীং আলোচনায় আল জাজিরা। আল জাজিরার বহুল আলোচিত সেই সো-কল্ড অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি দেখেননি এমন শহুরে মানুষ এখন এদেশে বিরল। প্রতিবেদনটি প্রচারের আগে প্রচার-প্রচারণা ছিল ব্যাপক। প্রচারণা যেমন ছিল চ্যানেলটির পক্ষ থেকে, তেমনি স্যোশাল মিডিয়া দাপিয়েছেন তারা, যারা এটি থেকে ফায়দা লোটার আশায় তক্কে-তক্কে ছিলেন। তাছাড়া প্রতিবেদনটি দফায়-দফায় প্রচার করে আল জাজিরা বাংলাদেশে শতভাগ কাভারেজ নিশ্চিত করায় তাদের চেষ্টায়ও কোনো ত্রুটি রাখেনি। আল জাজিরার এই প্রতিবেদনটির সারবক্তব্যটি অবশ্য অসার। আর এ নিয়ে লেখালেখি আর বলাবলিও কম হয়নি। কাজেই আমি সেদিকটায় না হয় আর নাই গেলাম।

আল জাজিরার এই প্রতিবেদনটি যে কারণে আমার নজর কেড়েছে তা হলো এটি প্রচারের সময়জ্ঞানটি। প্রতিবেদনটি এমন একটি সময়ে প্রচার করা হয়েছে যখন আমাদের সেনাবাহিনী প্রধান সরকারি সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বলাই বাহুল্য প্রতিবেদনটিতে তার কাঁধে রেখেই বন্দুকটি দাগা হয়েছে। আর প্রতিবেদনটি প্রচারে সময়টাও এমনভাবে বেছে নেয়া হয়েছে যেন মনে হয় তিনি প্রতিবেনদটি প্রচারিত হচ্ছে যেনেই আগেভাগে বিদেশে চলে গেছেন, যেমনটি হরহামেশাই করে থাকে আমাদের সমাজের উঁচুতলার দুর্নীতিবাজরা। পাশাপাশি প্রতিবেদনটি এমন একটা সময় প্রচার করা হয় যার ঠিক আগে-আগে প্রতিবেশী মিয়ানমারে সংগঠিত হয়েছে একটি সেনাঅভ্যুন্থান। স্পষ্টতই আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে উসকানি দেয়ার যথেষ্ট উপাদান এর মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট।

আল জাজিরার মাছ শিকারের সুবিধার্থে জলঘোলা করার প্রক্রিয়াটি অবশ্য শুরু হয়েছিল আরেকটু আগেই। পুরো করোনাকালে নিশ্চুপ যে বিরোধী দল, হঠাৎই তাদের লক্ষণীয় নড়াচড়া ছিল গত ক’দিন ধরেই। ভ্যাকসিনবিরোধী জেহাদে নেমেছিলেন তারা। ভ্যাকসিনের দাম থেকে শুরু করে এর কার্যকারিতা আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া- হেন বিষয় নেই যা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়নি তাদের পক্ষ থেকে। করোনা ভ্যাকসিনের বোতলের গায়ে অর্বাচীনকে দেখেছি মুরগির ভ্যাকসিনের লেবেল সেটে দিতে। অথচ আল জাজিরার প্রতিবেদনটির ক্রাশ ল্যান্ডিংয়ের পর সব কেমন যেন চুপচাপ। এমনকি মুরগির ভ্যাকসিন তত্ত্বপ্রণেতাকেও ভ্যাকসিন নিয়ে মিডিয়ায় ভ্যাকসিনের গুণগান গাইতে দেখলাম।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘোলাজলে মাছ শিকারের এই চেষ্টা একেবারেই নতুন না। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সময়টাতেও জল ছিল যথেষ্টই ঘোলা। বাসন্তীর জালে জড়ানো ছবি গোটা জাতিকে বিভ্রান্ত করেছে অথচ কেউ ভাবেনি, যে বাসন্তীর শাড়ি কেনার অর্থ জোটে না, সে জালটা কেনে কোত্থেকে? শেখ কামালের মতো একজন সব্যসাচী ব্যক্তিত্বকেও পর্যন্ত নামিয়ে আনা হয়েছিল ব্যাংক ডাকাতের পর্যায়ে। পঁচাত্তরের পরও বিভ্রান্তি আর ধূম্রজালের ধোঁয়াশায় গোটা জাতিকে আচ্ছন্ন রেখে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র তাদের কাজগুলো ঠিকঠাক মতোই করে গেছে।

এ সময় ইতিহাস বিকৃতিকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যে, আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে একজন মেজরের এক ঘোষণায় আমরা হানাদার বাহিনীকে হারিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করে ফেলেছিলাম নয় মাসের মধ্যে। মেজরের ঘোষণায় আমাদের স্বাধীনতার ক্যাম্পেইনের সূচনা আর তার শেষ ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে শিশুপার্কে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। আমি নিশ্চিত, যে গোয়েবলসকে আমরা এত গালাগাল দেই তিনিও যদি আজ বেঁচে থাকতেন তবে বড়ই শরমিন্দা হতেন।

আল জাজিরার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনটি এই অশুভ প্রক্রিয়ারই ধারাবহিকতা মাত্র। আল জাজিরার জন্য অবশ্য এটি নতুন কিছুও না। ভুলে গেলে চলবে না এরা যে শুধু আমাদের সেনাপ্রধানকেই বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছে তাই নয়, অতীতে এরা বিতর্কিত করতে চেয়েছে আমাদের যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়াকেও। আর এই ক’দিন আগেও যারা প্রচার চালিয়েছিল যে, কোভিডে বাংলাদেশে লক্ষ-লক্ষ মানুষের মৃত্যু হবে, তাদের কাতারেও একদম সামনের দিকেই ছিল এই প্রচার মাধ্যমটি। তবে এবারে তাদের বাড়টা একটু বেশিই বেড়েছে। এবার তারা ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছে এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও বিতর্কে জড়ানোর। আর তাদের বড় ভুলটাও এটাই। এ কারণেই তাদের এই প্রতিবেদনটি হালে এক ফোটা পানিও পায়নি।

তবে আল জাজিরা আর আল জাজিরাচক্রের আরও একটি চক্রান্ত মাঠে মারা গেছে বলে আমাদের আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনোই সুযোগ নেই। এই সরকারকে ভবিষ্যতের মানুষ যেসব কারণে স্মরণে রাখবে তার একটি বড় কারণ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এর অবদান। এই সরকারের মেয়াদেই বিচারের আওতায় এসেছে যেমন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা, তেমনি বিচার হয়েছে এবং হচ্ছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ীদেরও। সদ্যই সিদ্ধান্ত হয়েছে জিয়াউর রহমানসহ বঙ্গবন্ধুর খুনের সাথে জড়িত এবং খুনের মদতদাতাদের মুক্তিযোদ্ধা খেতাব বাতিলেরও।

এরই ধারাবাহিকতায় আল জাজিরাকেও আইনের আওতায় আনা একান্তই জরুরি। তারা আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে উসকানি দিয়ে একদিকে যেমন রাষ্ট্রদ্রোহিতা করেছে তেমনি বিশ্বের যে প্রান্ত থেকেই সম্প্রচারিত হোক না কেন, আল জাজিরার অনুষ্ঠান যেহেতু দেখা গেছে বাংলাদেশেও, কাজেই তারা আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও অপরাধ সংগঠিত করেছে। কাজেই আমাদের দেশের প্রচলিত আইনেই তাদের বিচার করা সম্ভব।

অনেকে বলেন কাতার আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র। কাতার সরকারের মালিকানাধীন আল জাজিরার বিরুদ্ধে মামলা করলে সেটি তারা হয়তো সহজভাবে নেবেন না। আমার কিন্তু একেবারেই তা মনে হয় না। এর আগেও আমরা বন্ধুপ্রতীম কানাডার মালিকানাধীন নাইকোকে বিচারের মুখোমুখি করেছি। এমনকি বাংলাদেশে অপরাধ সংগঠনের দায়ে সেদেশের নামি কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনকেও সেদেশের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে কানাডা সরকার। কাজেই আল জাজিরাকে বিচারের আওতায় আনলে তাতে কাতার অখুশি হবে এমনটি মনে করার কোনোই কারণ নেই। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে এটাই এখন প্রত্যাশা।


লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

-চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

-সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

 

 

 

মুক্তআলো২৪.কম