আগস্টের অসম্পূর্ণ অঙ্গীকার:অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব(স্বপ্নীল)

মুক্ত আলো

প্রকাশিত : ১০:১৫ পিএম, ১৪ আগস্ট ২০২১ শনিবার

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

 

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল):
বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে শোকাবহ মাসটি আগস্ট। সংগত কারণেই এই মাসজুড়ে আমরা শুধু বঙ্গবন্ধু আর পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে তাঁর সঙ্গে শাহাদাতবরণকারী তাঁর পরিবারের সদস্যদেরই শ্রদ্ধায় স্মরণ করি না, আমরা পাশাপাশি ১৫ই আগস্টের প্রেক্ষাপট আর আজকের প্রেক্ষাপটে ১৫ই আগস্ট—এসব নানা বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণেরও চেষ্টা করি। নানা আলোচনায় উঠে আসে এসব বিষয়। আগস্টের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আগস্টে ১৫ ছাড়াও আরো কতগুলো কালো তারিখ আমাদের জাতির ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। আছে আগস্ট ১৭, যেদিন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সিরিজ বোমা হামলায় কেঁপে উঠেছিল একটি বাদে দেশের প্রতিটি জেলা। আছে আগস্ট ২১, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যেদিন প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে। সেদিন তিনি স্রষ্টার অসীম কৃপায় প্রাণে রক্ষা পেলেও শাহাদাতবরণ করেছিলেন আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী।

আগস্টকে কেন্দ্র করে একাত্তরের পরাজিত শক্তির যে সক্রিয়তা দেশে এবং বিদেশে তা একাত্তর-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের একটি নিয়মিত ফেনোমেনন। একাত্তরের পরাজয়কে পাকিস্তানিরা কখনোই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে ১৬ই ডিসেম্বর বিকেলে ৯০ হাজারের বেশি পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা আর সৈনিকের বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সেনা কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণের মতো কোনো সেনাবাহিনীর এমন নির্লজ্জ পরাজয়বরণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কখনো দেখেনি বিশ্ব। শুধু তা-ই নয়, স্বাধীন দেশে এক বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু যে সংবিধানটি প্রণয়ন করেছিলেন তা-ও ছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পাকিস্তানের গালে বড় ধরনের চপেটাঘাত। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের চারটি মূলনীতির যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তা থেকেই এটি প্রতিভাত। তিনি নতুন করে গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। তাঁর গণতন্ত্র ছিল আব্রাহাম লিংকনের, ‘ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, অব দ্য পিপল’ থেকে স্বতন্ত্র। তাঁর গণতন্ত্র ছিল ‘শোষিতের গণতন্ত্র’। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এর আগে কেউ কখনো এভাবে গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করেননি। একইভাবে তিনি স্পষ্ট করেছিলেন যে তাঁর সমাজতন্ত্র, রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপ আর চীনা সমাজতন্ত্র থেকে স্বতন্ত্র। ‘তার সমাজতন্ত্র’ ছিল আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতাও ছিল লেনিন বা কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে একেবারেই আলাদা। বঙ্গবন্ধুর ‘ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে’ প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মচর্চার স্বাধীনতা ছিল। ধর্মকে শুধু রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে বিযুক্ত করা হয়েছিল। কারণ ধর্ম যখন রাষ্ট্র আর রাজনীতি নিয়ামক হয়ে ওঠে তখন তার ফলাফল দাঁড়ায় পাকিস্তানের মতো ধর্মভিত্তিক একটি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’।

একইভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় কখনোই মেনে নিতে পারেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের মতো পরাশক্তিগুলো, যারা একাত্তরে প্রকাশ্যে আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ওয়াশিংটন ও পিকিংয়ের মধ্যে ইসলামাবাদের মধ্যস্থতায় একাত্তরে যে ‘পিংপং ডিপ্লোমেসির’ সূচনা তা বড় ধাক্কা খেয়েছিল ১৬ই ডিসেম্বর। চীনারা এটি কখনোই স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে তারা দেখছিল আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারতের কাছে পরাজয় হিসেবে। যে কারণে বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদস্যপদ প্রাপ্তির প্রথম আবেদনে ভেটো দিয়েছিল চীন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এটিই ছিল প্রথম চীনা ভেটো। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতি ছিল মার্কিনদের জন্যও হুমকিস্বরূপ। তিনি একদিকে ঘোষণা করেছিলেন দ্বিধাবিভক্ত বিশ্বে তিনি শোষিতের পক্ষে, অন্যদিকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কিউবায় পাট রপ্তানির দুঃসাহসও দেখিয়েছিলেন তিনি।

এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকেই সক্রিয় ছিল নানা অশুভ শক্তি নানা অঙ্কের কারণে। মনে রাখতে হবে রাজাকার, আলবদর আর আলশামস ছিল নিয়মিত প্যারামিলিটারি বাহিনী। ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও কখনোই আত্মসমর্পণ করেনি তাদের এই অক্সিলারি বাহিনীগুলো। তারা আত্মসমর্পণে না গিয়ে আত্মগোপনে গিয়েছিল, যা এসব বাহিনীর শীর্ষ কর্তাদের লেখায় পরবর্তী সময়ে উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর সরকার ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে স্বাধীন দেশের আইন করে নিষিদ্ধ করলেও তারা গোপনে তাদের কার্যক্রম ঠিকই অব্যাহত রেখেছিল। আর শুধু ঢালাওভাবে এদের দায়ী করলেও চলবে না। সঙ্গে ছিল চীনপন্থী কমিউনিস্টরাও। কমরেড আব্দুল হক স্বাধীন বাংলাদেশে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির ব্যানারেই গোপন রাজনীতি চালিয়ে গিয়েছেন এবং এমনকি জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে অস্ত্র সাহায্যও চেয়েছিলেন। এসব সম্মিলিত অপশক্তি পাটকল আর পাটের গুদামে আগুন দিয়ে, থানা লুট করে আর আওয়ামী লীগের একাধিক নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে হত্যা করে ১৫ই আগস্টের প্রেক্ষাপটকে তৈরি করেছিল। সঙ্গে ছিল গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো জাসদও। আর এ ধরনের একের পর এক অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতায় বিদেশি সমর্থনও ছিল স্পষ্ট। চুয়াত্তরে দেশব্যাপী যে দুর্ভিক্ষ, পিএল-৪৮০ প্রগ্রামের অধীনে বাংলাদেশের জন্য চালবোঝাই জাহাজ মাঝপথে ঘুরিয়ে দিয়ে যে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই সৃষ্টি করেছিল তা এখন সর্বজনবিদিত। একইভাবে সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ছিল পাকিস্তানেরও, যার বর্ণনা আছে লরেন্স লিফসুলজের বইয়ে।

একাত্তরের মার্চে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে যাওয়ার আগে জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাঁর সেনাপতিদের নির্দেশ দিয়েছিলেন ‘তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ চান না, মাটি চান।’ একাত্তরের ৯ মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন নাৎসি ‘পোড়ামাটি নীতি’ নির্মম দক্ষতায় বাস্তবায়ন করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ৩০ লাখ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা আর তিন লাখ বীরাঙ্গনার সম্ভ্রম লুটে নিয়ে। পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের ঘটনাপ্রবাহকে শুধু কুদেতা হিসেবে দেখলে বড় ভুল করা হবে। এটি ছিল বাংলাদেশকে ‘মিনি পাকিস্তান’ বানানোর চক্রান্ত মাত্র। জেনারেল জিয়া যে শুধু ১৫ই আগস্টের বেনিফিশিয়ারিই ছিলেন তা-ই নয়, তিনি এর সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্তও ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারিক কার্যক্রমের নথি বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। জেনারেল জিয়াকে আমরা অনেকে অনেক পরিচয়ে চিনি। তবে তাঁর বড় পরিচয়টা তার পরও অনেকের অজানা, তা হলো তিনি ছিলেন পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের কর্মকর্তা। পাকিস্তানি এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা দায়িত্ব পেয়েই জেনারেল ইয়াহিয়ার অসমাপ্ত আদেশ বাস্তবায়নে তৎপর হয়েছিলেন। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তাঁর বইয়ে এসব বিষয় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন।

আমরা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী আর একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের অনেককেই বিচারের আওতায় আনতে পেরেছি ঠিকই, কিন্তু বাকি রয়ে গেছে পঁচাত্তরের নেপথ্যের কুশীলবদের চিহ্নিত করার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজটি। এখনো আমরা বিচারের আওতায় আনতে পারিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের। আমাদের পবিত্র সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি পুনঃস্থাপিত হলেও এখনো সেখানে রয়ে গেছে স্বৈরশাসকদের সাম্প্রদায়িক পদচিহ্ন। মাসটি যখন আবারও আগস্ট আর শোকে মুহ্যমান গোটা জাতি, তখন আমাদের কর্তব্য হচ্ছে এই অসম্পূর্ণ কাজটি সম্পন্ন করে অতীতের কলঙ্ক থেকে আগামী দিনের বাংলাদেশকে পাকাপাকিভাবে মুক্তি দেওয়া। এটাই হোক এই আগস্টে আমাদের অঙ্গীকার।


লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

-ডিভিশনাল হেড, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

-আঞ্চলিক পরামর্শক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

-সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ







 

মুক্তআলো২৪.কম