পনের আগস্টের বাস্তবতায় আমাদের এখনকার করণীয়:
অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব(স্বপ্নীল)
মুক্ত আলো
প্রকাশিত : ০২:৩০ পিএম, ১৭ আগস্ট ২০২১ মঙ্গলবার
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল):
১৫ আগস্টের শোকের ব্যপ্তিটা এতোটা বিশাল যে তা আমাদের যে শুধু এই একটা মাস জুড়েই আচ্ছন্ন করে রাখে না, পঁচাত্তরের পর ৪৬টি বছর পরে এসে এখনও আমরা আগস্টের এই তারিখটির কথা মনে করে শোকাবিষ্ট হই। আজও আমাদের আলোচনায় আর ভাবনায় অনেকখানি জুড়ে থাকে ‘কেন আগসেটর ১৫?’ বঙ্গবন্ধু যদি সেদিন ৩২-এ না থেকে, থাকতেন গণভবনের সুরক্ষিত পরিবেশে, কিংবা সেদিনের সেনাপ্রধান যদি বঙ্গবন্ধুর ফোনটা পেয়ে সে রাতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতেন, এমনি আরো অনেক ‘কী হলে কী হতে পারতো আর কেন হলো না’ ভাবনা আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে যখনই আমাদের আলোচনায় আসে বঙ্গবন্ধুর, বাংলাদেশ কিংবা আগস্ট। তেমনি বাংলাদেশের যারা প্রতিপক্ষ আর ১৫ আগস্টের যারা কুশীলব আর বেনিফিশিয়ারী, তারাও এ মাসটিকেই সঙ্গত কারণেই বরাবরই বেছে নেয় বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশের গোড়ায় আরো একবার জোড়ে আঘাত করার জন্য।
এই আগস্টেই তাই ১৫ ছাড়াও আরো একাধিক তারিখ আছে যা বাঙালির ইতিহাসকে পাকাপাকিভাবে কালিমালিপ্ত করেছে। আগস্টের ১৭-তে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়, তাদের প্রত্যক্ষ মদদে সিরিজ বোমা হামলায় প্রকম্পিত হয়েছিল মাত্র একটি বাদ দিয়ে দেশের বাদবাকি ৬৩টি জেলা। আর ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস বিরোধী জনসভায় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যে নির্লজ্জ সন্ত্রাস চালানো হয়েছিল, তাতে স্রষ্টার অপার কৃপায় তিনি সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও, এতে শাহাদৎ বরণ করেন আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী। পাশাপাশি আগস্টেই পাকিস্তান আর পাকিস্তানিদের পা-চাটা পাকিস্তানপন্থী মিডিয়াগুলো নানাভাবে সক্রিয় হয়ে উঠে বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ আর সাথে মুক্তিযোদ্ধা আর ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আরো একদফা বিতকেৃ জড়ানোর অশুভ চক্রান্তে। এ বছরও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি, ঘটবে তেমনটা অবশ্য প্রত্যাশায়ও ছিল না। সরকারের এই যে এতো সফল গণটিকাদান কর্মসূচি নানাভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা চলছে সেটিকেও। ১৫ আগস্ট থেকে এ ধরনের অপপ্রচারকে আলাদা করে দেখার সুযোগ সামান্যই। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের যে পেছন দিকে গোল্লাছুট তার যে শুধুু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা লাগামটাই টেনে ধরেছেন তা-ই নয়, বরং সামনের দিকে এখন উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে বাংলাদেশের বিজয়রথ। এই কোভিডকালেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিই ঈর্ষা জাগানিয়া। পাশাপাশি নিজস্ব টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা ছাড়াই বাংলাদেশই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশ যারা কোভিডের গণটিকাদান কর্মসূচি হাতে নিতে পেরেছে। বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীতে এমন দেশ আর দু-তিনটিও সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে পৃথিবীর তাবৎ ‘ভ্যাকসিন পরাশক্তিগুলো’ টিকা সরবরাহে কার্পণ্য করছেন না। মার্কিন, ইউরোপিয়ান কিংবা চীনা, কোন টিকা নাই আমাদের? নিজ নিজ দেশে কোভিডের তৃতীয় ওয়েভ কাটিয়ে উঠলেই ভারত আর রাশিয়া থেকেও যে ভ্যাকসিন বোঝাই কার্গো উড়োজাহাজ হযরত শাহজালালে অবতরন করবে তার আলামতগুলো এখন থেকেই স্পষ্ট।
বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল উদ্দেশ্যই ছিল বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতনই একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করা। তাদের সেই উদ্দেশ্য সেদিন সফল হয়নি। আমাদের কোভিডের গণটিকাদান কর্মসূচি আরো একবার তারই স্বাক্ষ্যবহ। আর তাই কখনও মুরগির টিকা তো কখনও বুড়িগঙ্গার পানি ইত্যকার নানা অপপ্রচার আর সর্বশেষ গণটিকাদানে বিশৃঙ্খলার ধোয়া তুলে এখন তারা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর আরো এক দফা চেষ্টা চালাচ্ছে।
একইভাবে পাকিস্তানের প্রচার মাধ্যমগুলো বিশেষ আগস্টকে কেন্দ্র করে নানা ধরেনের ‘গোয়েবলসীয় প্রচারণায়’ সক্রিয় হয়ে উঠে। তারা মানুষকে গেলাতে চায় যে বঙ্গবন্ধু আদতে পাকিস্তানের অখণ্ডতাতেই বিশ্বাসী ছিলেন। পাশাপাশি তারা একাত্তরের ন’টি মাসে এদেশে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর দায়দায়িত্ব সব মুক্তিবাহিনী আর ভারতীয় সেনাদের কাধে চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে। এই আগস্টে এরা অবশ্য এদের অতীতের সব অপপ্রচারের সীমাটা ছাড়িয়ে গেছে। এদের ধৃষ্টতা এতোটাই বেড়েছে যে তারা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষনের ভিডিওটিকে এডিটিং করে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের শেষে ‘জয় পাকিস্তান’ জুড়ে দেয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছে। শুধু তাই নয় তারা ‘পাক বাংলা যুক্তরাষ্ট’ বলে একটা অদ্ভুতুরে রাষ্ট্রের ফ্ল্যাগও ওই বির্তকিত ভিডিওটিতে সন্নিবেশিত করেছে।
ওরা যখন আমাদের সহ্যের সবটুকু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, আমাদের মনে হয় আমাদেরও আর ধৈর্য্য ধরার কোনো অবকাশ আর নেই। আমাদের একদিকে যেমন পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের মদতদাতা আর কুশীলবদের একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের মাধ্যমে ভবিষ্যতের তাগিদে অবিলম্বে চিহ্নিত করতে হবে, তেমনি যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী জামায়াতে ইসলাম আর ১৯০ জনেও বেশি চিহ্নিত পাকিস্তানি সাবেক সেনা সদস্যের বিচারের প্রক্রিয়াটাও এখনই শুরু করতে হবে। আর এটি আমাদের করতে হবে শুধু আমাদের ইতিহাস থেকে কলঙ্ক মোচনের তাগিদ থেকেই নয়, পাশাপাশি ভবিষ্যত প্রজন্মের সামনে বাংলাদেশটাকে ঠিকঠাক মতো তুলে ধরার স্বার্থেও।
লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
-ডিভিশনাল হেড, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
-আঞ্চলিক পরামর্শক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
-সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
মুক্তআলো২৪.কম