ঢাকা, ২১ নভেম্বর, ২০২৪ || ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
Breaking:
সশস্ত্র বাহিনী দিবস: শিখা অনির্বাণে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা     
Mukto Alo24 :: মুক্ত আলোর পথে সত্যের সন্ধানে
সর্বশেষ:
  বাংলাদেশ ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে চায় : প্রধান উপদেষ্টা        জঞ্জাল পরিষ্কার করে দ্রুত নির্বাচন দিন : মির্জা ফখরুল        শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়ক শিক্ষাব্যবস্থা দরকার : ড. মুহাম্মদ ইউনূস     
৯৯৯

একজন নেলসন ম্যান্ডেলা: অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া

অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া

প্রকাশিত: ৯ আগস্ট ২০২১  

অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া

অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া

 

অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া:

পৃথিবীতে যুগে যুগে অনেকেই ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন। কিছু কিছু মানুষের জন্ম হয়, ভোগের জন্য নয়, ত্যাগের জন্য, মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য, ব্যক্তি জীবন সেখানে একেবারেই তুচ্ছ, ব্যক্তি জীবনের আনন্দ, সুখ-শান্তি কখনোই ছুয়ে দেখতে পারেন না, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তারা মানুষের জন্য, মানব জাতির জন্য, তার দেশের জনগণের জন্য বিসর্জন দেন, অনেকে আবার রক্ত দিয়ে প্রমান করেন, ‘আমি তোমাদেরই লোক’ এইসব মানুষগুলো একসময় মহীরুহ হয়ে মহাপুরুষে পরিণত হন।  একটা জাতির মুক্তিদাতা হিসাবে কেউ কেউ জাতির পিতার স্বীকৃতি লাভ করেন। এই অবিনশ্বর নামগুলো ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা যায় না। ভারতের মহাত্মা গান্ধী, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন মেন্ডেলা, বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভিয়েতনামের হো চি মিং, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ন, যুগোশ্লাভিয়ার মার্শাল টিটো, তুরষ্কের কামাল আতা তুর্ক, চীনের মাও সেতুং, সোভিয়েত এর ভ ই লেলিন, কাল মার্ক্স, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহিম লিংকন, মার্টিন লুথার কিং, প্যাট্রিক হেনরি, যুক্তরাজ্যের উইনস্টন চার্চিল ছিলেন এক একটা লাল উদিত সূর্য, উজ্জ্বল নক্ষত্র, অবিনশ্বর নাম। তাদের মধ্যে অন্যতম বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার থেমবো রাজকীয় পরিবারের বাবা গাদলা হেনরি এমপাকাইসা মেন্ডেলা ও মাতা নেসিকেনি ফ্যানির কোলে এমভেজো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম ছিল রোলিহা¬হলা ডালিভূঙ্গা মানডেলা। যে সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ সেই সম্পদ্রায়ের নাম - ‘ঝোসা’ সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের স্থানীয় ভাষায় রোহিংলাহলার আক্ষরিক অর্থ “কোন একটা গাছের ডাল ধরে ঝুলে পড়া” অথবা “ঝামেলাবাজ”। দক্ষিণ আফ্রিকার এই নেতার জন্মের পর থেকেই সংগ্রাম আর সংগ্রাম। সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস এই মহান ব্যক্তি, ০৭ বছর বয়সে মেন্ডেলা তার পরিবারের প্রথম স্কুলে পড়াশোনা করতে যায়। কুনু গ্রামে মাতামহের বাসায় থেকে মিশনারী স্কুলে হাতেখড়ি। মিশনারী স্কুলের শিক্ষক টিং গানে তার নাম খ্রিষ্টান ইংরেজী নাম রাখলেন নেলসন। এভাবেই তিনি রোলিহা¬হলা ম্যান্ডেলা  থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা হলেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগে পিতাকে হারান ম্যান্ডেলা। ১৬ বছর বয়সে গোত্রে বরণ করে অভিভাবক নিযুক্ত হন থিম্বু শাসন জোঙ্গিন্তাবা ও তার স্ত্রী নোয়েঙ্গ ল্যাগু। তারা দুজনেই সন্তানের মতো আদর করতেন। নিজ পুত্র জাসটিজ ও কন্যা নামাফুর সাথে তাকে লালন-পালন করেন। ১৬ বছর বয়সে খতনার পর নামকরণ হয় ডালিভূঙ্গা নামে। রাজপ্রাসাদের আফ্রিকার ইতিহাস বিষয়ে ভক্ত সাম্রাজ্য বিরোধী জোয়ী নামক এক ব্যক্তির দ্বারা প্রভাবিত হন। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন অলিভার টাম্বো।

স্কুল পাশ করার পর ম্যান্ডেলা ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.এ কোর্সে ভর্তি হন। কারাগারে বন্দি অবস্থায় তিনি ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকা থেকে দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের অধীনে ১৯৪৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এর পর তিনি ইউনিভার্সিটি অব উইট ওয়াটারস রান্ডে আইন বিষয়ে স্নাতোকোত্তর পড়াশোনা শুরু করেন। এক সময়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেলসন মেন্ডেলা আইনে স্নাতক ডিগ্রি পেয়ে যান। 

তবে এখানে তিনিই একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান শিক্ষার্থী ছিলেন। ছাত্র অবস্থায় সাদা কালো বর্ণবাদী ভেদাভেদ তাকে মানসিক ভাবে ভীষন কষ্ট দিত। একই দেশে দুই সমাজ ব্যবস্থায় বস্তিবাসী শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, ক্ষুধা আর সাদা মানুষের পুলিশী নির্যাতন তাকে ব্যথিত করে তুলতো। ১৯৪৩ সালেই তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস এ যোগদান করেন। রাজপ্রাসাদে বিয়ের প্রস্তাব করা হলে জোহান্সবার্গে পালিয়ে এসে প্রথমে জীবিকার তাগিদে কিছুদিনের জন্য উন্মুক্ত খনিতে কাজ করেন। যে বিয়ের প্রস্তাবে জোহান্সবার্গে পালিয়ে এসেছিলেন শেষ পর্যন্ত তিনি জীবনে তিন তিন বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন ইবলিন নতোকো মাসে। ১৯৪৪ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ১৩ বছর সংসার করে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন উইনি মাদিকীজেলা মেন্ডেলা। ১৯৫৭ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৯ বছর রাজনৈতিক ও জীবনের সঙ্গী হিসাবে ছিলেন। ৮০ বছর বয়সে তৃতীয় স্ত্রী হিসাবে বেছে নিলেন মোজাম্বিকের সাবেক ফার্ষ্ট লেডি গ্রাসা মার্চেলকে। নেলসন মেন্ডেলা ছিলেন ০৬ (ছয়) সন্তানের জনক। ১৯৪৪ সালে এএনসি’র ইয়ুথ শাখা প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৫০ সালে মেন্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের জাতীয় নির্বাহী হিসেবে নিযুক্ত হন এবং এএনসি’র যুব শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে ০১ ল’ ফার্মে কাজ শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে এএমসি’র ওপর রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করলে তিনি উপলদ্ধি করেছিলেন সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া মুক্তির পথ নেই। তিনি ১৯৬১ সালে সশস্ত্র সংগঠন উমখন্ডো উই সিযওয়ে’র নেতা হিসাবে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এই সংগঠনের সংক্ষিপ্ত নাম এমকে এবং তিনি এই সংগঠনের সহ প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। মেন্ডেলা তাঁর সশস্ত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে নিতান্তই শেষ সম্বল বলে অভিহিত করে এই সশস্ত্র আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তিনি স্বীকার করেছিলেন যে, বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধসহ সশস্ত্র সংগ্রাম করতে গিয়ে অনেক সময় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। ২০০৮ এর জুলাই পর্যন্ত ম্যান্ডেলা ও এএনসি’র কর্মীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশ করা নিষিদ্ধ ছিল। কেবলমাত্র জাতিসংঘের সদর দপ্তরে যাওয়ার অনুমতি ছিল। ম্যান্ডেলা সংগ্রাম করতে গিয়ে বহুবার কারাগারে আটক ছিলেন। ১৯৬৪ সালে সর্বশেষ সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব দানের অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে মামলা দেন। যেটাকে রিভোনিয়ার মামলা নামে খ্যাত। ১৯৬৪ সালে শেষ পর্যন্ত ফাসির রায়ের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছিল। ২৭ বছরের কারাগারের মধ্যে রবেন দ্বীপের নির্জন কারাগারে কাটান ১৮ বছর। এখানেও বর্ণবাদ প্রথা চালু ছিল। কৃষ্ণাঙ্গ বন্দীদের সবচেয়ে কম খাবার দেওয়া হতো। ১৯৮২ সালে ম্যান্ডেলাকে বরেন দ্বীপের কারাগার থেকে পোলসমুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৮৫ সালে সেখানে তদানীন্তর রাষ্ট্রপতি বোথা পি ডব্লিউ মেন্ডেলাকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দেন। সেই প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখান করে কন্যা জিঞ্জির মাধ্যমে প্রস্তাবের জবাব দেন, ‘নিজের মুক্তি আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমার জনগণের মুক্তি। আমি আমার জন্ম অধিকার বিক্রি করতে পারি না, যেমন বিক্রি করতে পারি না আমার মানুষের মুক্ত হওয়ার অধিকার। আমি জেলে আসার পর অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছেন। সেসব সন্তানহীন বাবা মা, স্বামীহারা বধূ ও বাবাহারা সন্তানদের প্রতি আমার ঋণ ভুলে, এই মুক্তি আমি চাই না।’ ১৯৯৮ সালে ম্যান্ডেলাকে ভিক্টোর ভার্সটার কারাগারে সরিয়ে নিয়েছিলেন। মুক্তির আগের দিন পর্যন্ত এই কারাগারেই বন্দি ছিলেন। ‘Free Nelson Mandela’  আন্দোলনে সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত এই স্লোগান আফ্রিকা থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছড়িয়ে পড়লো। বিশ্বের অগণিত মানুষ তাঁর মুক্তি কামনা করেন। ১৯৮৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি বোথা হৃদরোগে আক্রান্ত হলে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তার স্থলাভিসিক্ত হন ফ্রেডেরিক উইলেম ডি ক্লার্ক। ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ডি ক্লার্ক দক্ষিণ আফ্রিকার এই অবিসংবাদিত নেতাকে অবশেষে মুক্তি দেন এবং এএনসি’র ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। এই দিন ছিল ঐতিহাসিক এক দিন। সুদীর্ঘ টানা ২৭ বছর পর কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে জাতির উদ্দেশ্যে এক ঐতিহাসিক ভাষন প্রদান করেন। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত তিনি এই দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করে সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। শুরু হয় সরকারের সাথে শান্তি আলোচনা। শান্তি আলাচনার মাধ্যমে ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে প্রথম বারের মতো সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৪ এর ২৭ এপ্রিল সাধারণ নির্বাচনে নেলসন ম্যান্ডেলা বিপুল ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১০ মে ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন ম্যান্ডেলা। তাঁর নেতৃত্বেই দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন সংবিধান রচিত হয়। যার প্রধান বিষয় ছিল -গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠা। নেলসন ম্যান্ডেলা শান্তি ও সংহতির এক আদর্শ নেতা হিসাবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বর্ণবাদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে বহুজাতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নায়ক ছিলেন। বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের প্রতিকৃত ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তিন দশক জেলে বন্দী হয়েও ম্যান্ডেলা সংখ্যালঘু শেতাঙ্গ শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের ন্যায্য অধিকারের মুক্তি সংগ্রাম থেকে পিছু হটেন নি। তিনি অধিকার আদায়ের জন্য জাতিসত্ত্বার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য সাম্রাজ্য বিরোধী, আগ্রাসী শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, জাতিসত্ত্বার জন্য কখনো কখনো কমিউনিষ্টদের অনুপ্রবেশ এর বিরুদ্ধে ছিলেন। আবার তিনি লেলিন, কার্ল মার্কস এর বই পড়ে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হলেন। মুক্তির সংগ্রামে রাজনৈতিক সব পথ রুদ্ধ হলে তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের বা বিপ্লবের পথ বেছে নিলেন। ফ্রিদেল কাস্ট্রো ছিলেন তাঁর প্রিয় ব্যক্তিত্ব, মহাত্মা গান্ধীর অহিংস রাজনীতি, তাঁর জীবনের দর্শন যুক্ত হলো। আর এই জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক, আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্ব, প্রখর রসবোধ, উদারতায় তিক্ততা ও দীর্ঘ বৈরীতা ভুলে প্রতিপক্ষের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং সাম্য, ভাতৃত্ব, সংহতি ও মানবতার নেতায় পরিনত হলেন। তিনি বলেছিলেন - ‘পৃথিবীতে প্রতিশোধ গ্রহণের মাধ্যমে আপনি যতটা অর্জন করতে পারবেন, তার চেয়ে ঢের বেশি অর্জন করতে পারবেন ক্ষমা প্রদর্শনের মাধ্যমে, সাহসী মানুষের শান্তির জন্য ক্ষমা করতে ভীত নই।’ তার অমূল্য বাণী - ‘আমি বর্ণবাদকে ঘৃণা করি কারন এটা একটা বর্বর বিষয়, তা সে কালো বা সাদা যেকোন মানুষের কাছ থেকে আসুক না কেন’। শান্তি আলোচনায় অবদান রাখার জন্য ১৯৯৩ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা নোবেল শান্তি পুরষ্কারে ভূষিত হন। নেলসন ম্যান্ডেলা বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন জীবন সংগ্রামের অভিজ্ঞতা নিয়ে। তাদের মধ্যে অন্যতম‘Conversation with Myself, ‘A Long Walk to Freedom’, ‘No Easy to Walk’, ‘The Struggle is My Life’, A Prisoner in the Garden.  নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম হয়েছিল ১৮ জুলাই, ১৯১৮ সালে আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ আফ্রিকার এমভেজো গ্রামে এক রাজ পরিবারে। সম-সাময়িক সময়ে ১৭ মার্চ ১৯২০ সালে আরেক বাঙ্গালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এশিয়া মহাদেশের বাংলাদেশে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দুই মহাদেশের এই দুইজন নেতা কেউ কাউকে মুখোমুখি দেখেন নি। বাংলাদেশের রজত জয়ন্তী দিবসে ২৬ মার্চ ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে বিশ্বের মুক্তির প্রতীক নেলসন ম্যান্ডেলা বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন একই মঞ্চে ছিলেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট ইয়াসিন আরাফাত, তুরষ্কের রাষ্ট্রপ্রধান সোলেমান ভোমিরেল ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর তনয়া শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীতে বিশ্বের এই নেতৃবৃন্দ ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপিত শিখা চিরন্তন উদ্বোধন করেছিলেন। এই মহান নেতা বাংলাদেশের সুস্বাদু খাবার আম খেতে চেয়েছিলেন এবং গানের তালে তালে নৃত্য করেছিলেন। আর বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতার জন্য বাঙ্গালীর যে আত্মত্যাগ, আমি এসেছি তার প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে। স্বাধীনতা আর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের অনেক মিল রয়েছে। আজ আমরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি, বাংলাদেশের মানুষকেও এক সময় এরকম সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে।’ আর এই বাংলাদেশের সৃষ্টির মহানায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, রাখাল রাজা, একটি অবিনশ্বর নাম, ভালোবাসার কাঙাল, সংগ্রামী আরেক মহানায়কের নাম, হৃদয় ছিল যার দিঘীর জলের মতো স্বচ্ছ - সমুদ্রের মতো ছিল বিশাল, মন ছিল আকাশের মতো উদার, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী এই সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে সেই অমর বানী - ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের আপোষহীন এই দুই নেতা ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ম্যান্ডেলা যেমন বলেছিলেন - দুই দেশের মানুষের সংগ্রামের ইতিহাসের মিল আছে, তেমনই দুই মহান নেতার দারুন মিল খুঁজে পাওয়া যায়। দুজনেই ছিলেন আপোষহীন নেতা, দু’জনেই অধিকার আদায়ের জন্য জেল খেটেছিলেন বহুবছর, ম্যান্ডেলা ২৭ বছর, বঙ্গবন্ধু ১২ বছর এবং আরো ১২ বছর নির্যাতন, হয়রানী ও নজরবন্দীর শিকার হয়েছিলেন। উভয়েই জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন নি। দুজনেই দেশের মানুষকে ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে ভালোবাসতেন, জনগণ ও দুজনকে ভালোবাসতেন এবং দুজনের জন্য অগণিত মানুষ তাদের প্রাণ দিয়েছেন। জনগণ ভালোবাসায় শিক্ত হয়ে একজনকে বঙ্গবন্ধু বলে ডাকতেন। আর মেন্ডেলাকে ডাকতেন মাদিবা বলে। উভয়েই জাতিসত্ত্বার অধিকারের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। দুজনেই কখনোই মাথা নত করেন নি। তাদের কাছে ব্যক্তি স্বার্থের চেয়ে আদর্শ ছিল অনেক বড়। ক্ষমতার 

প্রতি লোভ ছিল না এই দুই নেতার, দুই নেতাই প্রধানমন্ত্রীত্ব চায়নি। চেয়েছেন নিজের দেশের মানুষের অধিকার। তারা উভয়েই অধিকার আদায়ে সফল নেতা। জনগণকে স্বাধীনতা ও মুক্তি দিয়ে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছিলেন এই দুই নেতা। উভয়ে দুই জাতির শুধু দুটি প্রিয় নাম - ‘বঙ্গবন্ধু’ বা ‘মাদিবা’ নয় - দুটি মৃত্যুহীন ইতিহাস। ম্যান্ডেলার কারাগারে এখনো - একটা কম্বল, একটা প্লেট, একটা গ্লাস ও একটা জগ আছে। জেলখানায় ম্যান্ডেলার এগুলোই ছিল দীর্ঘ ২৭ বছরের সম্বল। বঙ্গবন্ধুও কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থটির শিরোনাম দিয়েছিলেন - ‘জেলখানার সম্বল, থালা, বাটি, কম্বল।’ দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ সরকার বার বার আপোষের প্রস্তাবে রাজি হলে আগামীকালই মুক্তি পাবে তার উত্তর ছিল - ‘আমি মুক্তি চাই না, জনগণের অধিকার চাই।’ এটা এমন একটি আদর্শ যদি প্রয়োজন পড়ে, যার যার জন্য আমি জীবন দিতে প্রস্তুত আছি। পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি জেলের সামনে কবর খুড়ে রেখে বঙ্গবন্ধুকে বেছে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ‘প্রধানমন্ত্রীত্ব’ না ‘কবর’। বঙ্গবন্ধু কবরকে বেছে নিয়ে নিয়েছিলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, আমি ভালোবাসার কাঙাল, আমি সবকিছু হারাতে পারি, তবুও এদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারবো না। মৃত্যুর পর এই কবরে নয়, আমার লাশ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিও।’ বঙ্গবন্ধু ৪ মার্চ ১৯৭১ সালে বলেছিলেন – ‘চরম ত্যাগ স্বীকার করা চাড়া কোনদিন কোন জাতির মুক্তি আসে নাই।’ দেখুন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন - ‘জনগণের মুক্তির জন্য অবশ্যই সবকিছু ত্যাগের জন্য নেতাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।’ ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, যে মরতে চায় তাকে কেউ মারতে পারে না। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, যে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত তার মৃত্যু নাই। দুজনের মধ্যে কি দারুন মিল। ১৯৫২ সালে মেন্ডেলা বলেছিলেন, একদিন আমি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হবো আর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, একদিন আমি এই দেশকে স্বাধীন করবো, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীত্ব আমার কাছে তুচ্ছ। এই দুই অকুতোভয় নেতা তার জাতিসত্ত্বার প্রতি শোষন, বৈষম্য, নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে অভিন্ন চেতনায় আজীবন মৃত্যুঞ্জয়ী যোদ্ধার মতো লড়াই করে অবশেষে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। 
১৯৯৯ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়ার পরও তিনি মানবাধিবকার বিষয়ে সবসময় সোচ্চার ছিলেন এবং এইডস এর সচেতনতার সৃষ্টির প্রচারে জোড়ালো ভূমিকা রাখেন। ২০০৯ সালে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, শান্তি, মানিবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার জন্য জাতিসংঘ তার জন্মদিন ১৮ জুলাইকে নেলসন ম্যান্ডেলা আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে ঘোষনা দেওয়া হয়। ২০০১ সালে প্রস্টেট গ্রন্থিতে ক্যান্সার ধরা পড়ে ম্যান্ডেলার। তিনি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। ক্যান্সার, ফুসফুসের প্রদাহ সহ অন্যান্য কারনে ০৫ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে মুক্তিকামী মানুষকে কাঁদিয়ে এ পৃথিবী ছেড়ে চির বিদায় নিয়েছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা বিশ্বকে দেখিয়ে গেলেন এবং বলে গেলেন মানুষ মানুষে ভেদাভেদ নেই। তিনি কল্পলোকের সত্যিকারের এক নায়ক। আত্মত্যাগের মহান প্রতীক, তিনি কালো আফ্রিকার মুক্তির লাল সূর্য হয়ে উদিত হয়েছিলেন। পরিশেষে, জয়তু নেলসন মেন্ডেলা, জয় হোক বিশ্ব মুক্তিকামী মানুষের।

 

মুক্তআলো২৪.কম

 

 

আরও পড়ুন
পাঠক কলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত